সাধারণের অসাধারণত্ব
"হু হু, তুমি পারবে না বাপু!" "হাতি ঘোড়া গেল তল, ব্যাঙ বলে কত জল"। কিংবা এরকম আরও কথা। কোনো কাজ করতে গিয়ে থেমে যাচ্ছেন "বিশেষজ্ঞ"দের কথা শুনে? ভয় পাচ্ছেন, পিছিয়ে যাচ্ছেন কারো "হবে না", "পারবে না" এরকম রায় দেখে?
"আম জনতা" বলে একটা শব্দ আমরা চালু করেছি। মানুষ যেন দুই রকমের -- সেলিব্রিটি অসামান্যেরা, আর আম-জনতা। আর আমাদের মিডিয়া, জনমনে, সবখানে চলে এই অসাধারণদের গল্প, সবাই জয়জয়কার করি তাদের নিয়ে। মেনে নেই তাদের সব অভিমত। কিন্তু সাধারণেরা কি অসামান্য নন? অসাধারণেরা কি সমালোচনা, হিসাবের বাইরে? প্রশ্নের উর্ধ্বে? তাদের কথাই বেদবাক্য, আম জনতার তাকে প্রশ্ন করা মানা? জটিল আলোচনায় না গিয়ে বিজ্ঞানের জগত থেকে তিনটা গল্প শোনা যাক।
তাই অসামান্য অসাধারণ সেলিব্রিটিদের কথাকে বেদবাক্য হিসাবে মানা বাদ দিন, কারণ তারা নন, ভবিষ্যত গড়বেন আপনি, আমি, আম জনতা, সাধারণেরাই।
আজ থেকে ১২০ বছরের মতো আগে কিছু পাগলাটে মানুষের মাথায় ভুত চেপে ছিলো, তারা আকাশে উড়তে চায় পাখির মতোই। বিজ্ঞ বিজ্ঞানী অসামান্য অসাধারণেরা কী রায় দিয়েছিলেন? সেসময়কার ডাকসাইটে বিজ্ঞানী লর্ড কেলভিন বলে দিলেন, "বাতাসের চাইতে ভারি কোন কিছু কক্ষনো উড়তে পারবেনা"। মানে বেলুন ছাড়া ওড়াটা অসম্ভব। এরকম বিজ্ঞ বিশেষজ্ঞের কথা শুনে অনেকেই থেমে গেলেন, কিন্তু দুই সাধারণ সাইকেল মিস্তিরি ভাই উইলবার রাইট আর অরভিল রাইট কিন্তু থামেননি, নিজেদের উদ্যোগে বানিয়ে ফেললেন প্রথম উড়োজাহাজ, সেটা আকাশে উড়ে প্রমাণ করে দিলো সাধারণ মানুষের অসাধারনত্বকে।
আরো বছর ২০ পরের কথা। রবার্ট গডার্ড নামে এক ক্ষ্যাপাটে বিজ্ঞানী সবাইকে বলে বেড়ান রকেটে করে মহাকাশে যাবার স্বপ্নের কথা। তাকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করে, এমনকি একবার বিখ্যাত পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমসের সম্পাদক বলে বসলেন, "প্রফেসর গডার্ড ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সূত্রটাই জানেন না, হাইস্কুলে যা পড়ানো হয়, সেটাও তিনি ভুলে বসেছেন, মহাকাশে যাওয়াটা অসম্ভব"। এই বিজ্ঞ সম্পাদকের জোঁক-মুখে নুন ঢেলে মানুষ যখন চাঁদে যায়, তখন রবার্ট গডার্ডের কথাটার সত্যতাই হয় প্রমাণিত। ১৯৬৯ সালে চাঁদে পদার্পনের সময়ে তাই নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকা বাধ্য হয় মাফ চাইতে প্রফেসর গডার্ডের আত্মার কাছে।
সবার শেষে বলি নামকরা কোম্পানি আইবিএম এর বড়কর্তা টমাস ওয়াটসনের কথা। ১৯৪৩ সালে যখন কিছু প্রকৌশলী কম্পিউটার নামের একটা যন্ত্র নিয়ে লাফালাফি করছে, তখন বিরক্ত হয়ে আইবিএম এর চেয়ারম্যান ওয়াটসন বলে বসেছিলেন, "সারাবিশ্বে মাত্র ৫টা কম্পিউটারের দরকার আছে", কাজেই এই ব্যবসার কোনো ভবিষ্যত নাই। ওয়াটসনের কথাটা একেবারেই ভুল প্রমাণিত হয়েছে, আজ সারা বিশ্বে মানুষের চাইতে কম্পিউটারের সংখ্যা বেশি, আর আইবিএম তাদের প্রায় সবটা আয়ই করে সেই কম্পিউটার থেকেই।
শেষ করি আরো একটা কথা দিয়ে, আমেরিকার প্যাটেন্ট অফিসের কমিশনার চার্ল্স ডুয়েল বলেছিলেন, ১৮৯৯ সালে, "নতুন আবিষ্কার?! না বাপু, যা আবিষ্কার করা সম্ভব, তার সবগুলাই আবিষ্কার হয়ে গেছে। নতুন আবার কী আবিষ্কার করবে মানুষ?" তাই অসামান্য অসাধারণ সেলিব্রিটিদের কথাকে বেদবাক্য হিসাবে মানা বাদ দিন, কারণ তারা নন, ভবিষ্যত গড়বেন আপনি, আমি, আম জনতা, সাধারণেরাই। কানে দিন তুলা, পিঠে বাঁধুন কুলা, আর সেই না-না-বলা সেলিব্রিটি বিশেষজ্ঞদের? ধরিয়ে দিন মুলা।