স্বপ্ন জয়ের পথে তোমাদের হতে হবে অনির্বাণ
আজকের গল্পটি অনেক ব্যক্তিগত।
সেদিন অনেক বৃষ্টি। ক্লাসে যাইনি। মনটা ভাল নেই। শীতের দিন বলে বিকেল ৩টার পরই সব অন্ধকার হয়ে গেছে। চারিদিকে কেমন একটি বিষন্নতা কাজ করছে। কোন কাজেই মন বসছে না। সত্যি বলতে, বেশ কয়েক দিন ধরেই এমন বিষন্নতার মাঝে বন্দি হয়ে আছি। তখন আমি জার্মানির স্টুটগার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উড়ন প্রকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। জার্মান ভাষায় পড়ার চ্যালেঞ্জ, স্টুটগার্টের মত শহরের খরচ মেটানো, জার্মানদের মাঝে নিজের অবস্থান করে নেয়া – সবই সামলে নিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে তখন দু’বছর ধরে সহকারি শিক্ষক (Teaching Assistant) হিসেবে কাজও করছি। এত কিছুর মাঝে ভাল রেজাল্টও ধরে রেখেছি। তবুও মনে হচ্ছিল বাস্তবতার কাছে আমি হেরে যাচ্ছি। উড়ন প্রকৌশল বিষয়ে ভাল চাকরির সুযোগ পাওয়াটা যে কতটা কঠিন হতে পারে, তা উপলব্ধি করতে থাকি। যেখানে জার্মানরাই পারছে না, সেখানে আমি কত দূর যেতে পারব? এত কিছু ছেড়ে এখানে এসে আমি কি ভুল করলাম? এত কিছুর পরও যদি আমাকে উড়ন প্রকৌশল ছেড়ে অন্য কিছু করতে হয়, তাহলে কী লাভ হল?
আজ যখন আকাশে বা বিমানবন্দরে কোন A380 দেখি, তখন একটু হলেও গর্ব হয়। আবার কিছুটা আবেগাপ্লুতও হয়ে যাই। ময়মনসিংহের সেই ইন্টার্নেট আর সেই ৪০টি আবেদন।
জানালার দিকে তাকিয়ে আছি। বৃষ্টি মনে হয় আজ আর থামবে না। হঠাৎ মনে হল আমার মোবাইল ফোন বাজছে। আমি বরাবরই আমার ফোনটি সাইলেন্টে রাখি। শুধু ভাইব্রেশনটা চালু রাখি। ফোনটা আমার অগোছালো বিছানার মাঝে কোথাও আছে। ভাইব্রেট করে যাচ্ছে। ভাবলাম ধরব না। ফোনটা থেমে গেল। কিছুক্ষণ পর আবার বেজে উঠল। এবার বিছানার কাছে গিয়ে ফোনটা খুঁজে নিলাম। দেখি নম্বরটি ০৪০ দিয়ে শুরু হয়েছে। অর্থাৎ, হামবুর্গ থেকে এসেছে। আমি নিশ্চিৎ, ফোনটি কোথাকার। ফোনটা ধরলাম। বাংলায় কথোপকথনটি মোটামুটি এমন ছিলঃ
- কলারঃ “আমি এয়ারবাস (Airbus) এর হামবুর্গ শাখার A380 Chief Engineering থেকে বলছি। এটা কি হের্ হাসান সাদ ইফতি?” (উল্লেখ্য, জার্মান ভাষায় জনাব বা Mr কে ‘হের্’ বা ‘Herr’ বলা হয়।)
- আমিঃ “জ্বী, বলছি।”
“হের্ ইফতি, আপনাকে অভিনন্দন! আমরা আপনাকে আমাদের A380 বিমানের Chief Engineering বিভাগে ইন্টার্নশিপের জন্য নির্বাচন করেছি। আমরা আরও খুশি হব যদি আপনি ছয় মাসের ইন্টার্নশিপ শেষে আমাদের বিভাগে আপনার থিসিসের গবেষণাটিও করেন।”
আমার আজকের গল্পটির শুরু এখান থেকেই। সেদিন এই ফোনটির কথা আমি কোন দিনই ভুলতে পারব না। কারণ, ফোনটি শুধু একটি ইন্টার্নশিপ বা সুযোগের ব্যাপার ছিল না। ছিল আমার বহুদিনের পরিশ্রমের স্বীকৃতি স্বরূপ।
এয়ারবাসে আমি মোট ৪০টি আবেদন বা application করি। যার প্রত্যেকটিই আলাদা ভাবে তৈরি করতে হয়েছিল। এর আগের ৩৯টি আবেদনই বিফল হয়। সঠিকভাবে এক একটি আবেদন তৈরি করতে কয়েক দিন পর্যন্ত লেগে যায়। দীর্ঘ দিন পর একটি একটি করে যখন আবেদনগুলো নাকচ হতে থাকে, নিজের ভেতরের মানুষটি যেন একটু একটু করে মরে যেতে থাকে। কাঁচের গ্লাসে যেমন ফাটল পড়তে পড়তে একদিন তা ভেঙে যায়, তেমনি আত্মবিশ্বাসেও দিন দিন ফাটল পড়তে পড়তে একদিন তা হারিয়ে যায়। এর আগে যে কোন কিছুতে বিফল হয়নি, তা কিন্তু নয়। বরং আর দশটা ছেলের চেয়ে বেশি প্রতিকূলতা সামলে ঐ পর্যায় গিয়েছিলাম। কিন্তু স্বপ্ন যত বড় হবে, সেই স্বপ্নের পথের কাঁটাগুলোও তত ধারালো হবে। স্বপ্নটার প্রতি যত বেশি ভালবাসা, বিফলতার আঘাতগুলো ঠিক ততটাই তীব্র। সত্যি বলতে কি, আমাদের বলা হয় যে, ‘সফল হতে হলে বিফলতার সাহায্য প্রয়োজন’ বা ‘failure is the pillar of success.’ কিন্তু গঠনমূলকভাবে বিফলতাগুলোকে কীভাবে যাচাই করা যায় বা মানসিকভাবে বিফলতাকে সামনে এগিয়ে যাবার জন্য কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, তা বলা হয় না।
পৃথিবীতে যাত্রীবাহী বিমান তৈরিতে সেরা হল বোয়িং (Boeing) এবং এয়ারবাস (Airbus). এর মাঝে এয়ারবাসের A380 মডেল হল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যাত্রীবাহী বিমান। ২০০৫ সালে এটি প্রথম বারের জন্য আকাশে উড়ে। তখন আমি স্কুলে পড়ি। আর তখন থেকেই আমার প্রিয় বিমানগুলোর তালিকায় স্থান করে নেয় A380 বিমানটি। সে সময় ময়মনসিংহে আমাদের ইন্টারনেট ছিল খুবই দুর্বল। ছবিসহ একটা পেইজ লোড হতে এক দিন লেগে যেত। তাই স্কুলে যাবার আগে এয়ারবাসের ওয়েবসাইট (www.airbus.com) এর একটা করে পেইজ খুলে যেতাম। রাতের মধ্যে লোড হয়ে যেত এবং পেইজটি সেইভ করে রাখতাম। এভাবে এয়ারবাসের ওয়েবসাইটের সকল পেইজ জমিয়ে ফেলি। পেইজগুলো বার বার পড়তাম। A380 সহ সবগুলো মডেলের টেকনিকাল ডাটা পড়তাম। বার বার পড়তে পড়তে ওদের ওয়েবসাইটের সবই জানা হয়ে যায় আমার। সে সময় থেকেই ইচ্ছা ছিল কখনও উড়ন প্রকৌশল পড়তে পারলে এয়ারবাসে একবার হলেও কাজ করব। তাই জার্মানিতে পড়া শুরু হতেই এয়ারবাসের সাথে যোগাযোগ করতে থাকি। এভাবে চার বার এয়ারবাস আমাকে ওদের ওয়ার্কশপে আমান্ত্রণ করে নিয়ে যায়। তবে সেখানে প্রকৌশল শাখায় ইন্টার্নশিপ পাওয়া বেশ কঠিন। এর পরও আমি জানতাম, প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হলে ইন্টারভিউতে আমি ভাল করতে পারব। আমার প্রয়োজন একটি মাত্র সুযোগ। সে সূত্রেই আমার ৪০টি আবেদন করা। আর কোন কোম্পানিতে আমি আবেদন করিনি।
কিন্তু স্বপ্ন যত বড় হবে, সেই স্বপ্নের পথের কাঁটাগুলোও তত ধারালো হবে। স্বপ্নটার প্রতি যত বেশি ভালবাসা, বিফলতার আঘাতগুলো ঠিক ততটাই তীব্র।
২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে আমি এয়ারবাসে যোগ দিই A380 Chief Engineering এ। আমার ইন্টার্নশিপ ছিল A380 এর Final Assembly Line এর ফ্লাইট টেস্টে (Flight Test) সহায়তা করা। এরপর গবেষণা করি A380 এর হাইড্রোলিক্স এর সমস্যার উপরে। এ বিষয়ে বিস্তারিত বলার অনুমতি আমার নেই। এ কাজের আয়তায় আমি নতুন তৈরিকৃত A380 বিমানগুলোর ভেতর ও বাহিরের সব দেখা হয়ে যায়। প্রথম দিকে আমার বিশ্বাসই হত না আমি সেখানে আছি। আমার অফিসের প্যানেরামা জানালা দিয়ে দেখতাম সামনে ব্র্যান্ড নিউ বিমানগুলি। সবুজ প্রাইমার দেয়া বিমানগুলো British Airways, Etihad, Qatar, Emirates এর রঙে সাজত। ইচ্ছা হলেই চলে যেতাম কোন একটির ভেতরে। পাখার ভেতরে বসে থাকতাম মাঝে মাঝে। এখানে বিমানের জ্বালানি, অর্থাৎ কেরোসিন থাকে। মাঝে মাঝে বিমানের বাহিরে গিয়ে ধরে দেখতাম। বিশ্বাসই হত না যে, ৪০০ মিলিয়ন ডলারের যে বিমানটি ময়মনসিংহের দুর্বল ইন্টার্নেটে দেখতাম, তা এখন আমার হাতে!
২০১৪ সালে এয়ারবাসে আমার কাজ সম্পন্ন হয়। আমার গবেষণার ফলাফল আজ A380 এর Final Assembly Line এ ব্যবহার করা হয়। এই গবেষণার ফলাফল দিয়ে এয়ারবাস দিনে কয়েক মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত সাশ্রয় করতে পারে। আমার কাজের শেষ সপ্তাহে টিম লিডার হিসেবে আমি প্রকৌশলীদের একটি দল নিয়ে একটি পরীক্ষামূলক ডেমনস্ট্রেশন করি, গবেষণার ফলাফলের কার্যকারিতা দেখানোর জন্য। আজ যখন আকাশে বা বিমানবন্দরে কোন A380 দেখি, তখন একটু হলেও গর্ব হয়। আবার কিছুটা আবেগাপ্লুতও হয়ে যাই। ময়মনসিংহের সেই ইন্টার্নেট আর সেই ৪০টি আবেদন। সত্যিই, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়।
জীবনের ছোট ছোট এই অর্জনগুলোকেও মনের মাঝে আগলে রাখি আমি। আমি বিশ্বাস করি, এই ছোট ছোট অর্জনগুলো আমাদের সামনের দিকে এগুতে সাহায্য করে, শক্তি যোগায়। এমন ছোট একটি অর্জন আরও ১০০টি বিফলতা সামলে নিতে সাহায্য করে। এমন একটি অর্জন নিজের স্বপ্নকে আরও বড় করে দেখার শক্তি যোগায়। নিজের স্বপ্নের গতিপথ চিনতে সাহায্য করে। এয়ারবাসে এক বছর থেকে আমি বুঝতে পারলাম যে, কোন কোম্পানিতে প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করার চেয়ে আমার গবেষণার অংশটি বেশি ভাল লাগে। আমি বার বার নতুন কিছু শিখতে চাই, জানতে চাই। আমি বুঝতে পারি যে, আমি গবেষক হতে চাই। সেখান থেকে আমার গবেষক হবার জন্য কাজ করে যাওয়া। সে বুঝ থেকেই পরবর্তিতে আমেরিকা যাওয়া, অক্সফোর্ডে আসা। দ্রুত গতির বিমান আর যাত্রীবাহী রকেটের উপর গবেষণা করা। এমন একটি বিমানও হয়ত কোন দিন আকাশে উড়বে। এমন একটি রকেটও হয়ত এক দিন যাত্রীদের নিয়ে উড়ে যাবে। আর সেদিন হয়ত পৃথিবীর কোন এক কোণে সেই বিমান বা রকেটটির উপর কাজ করার স্বপ্ন দেখবে কোন এক তরুণ বা তরুণী।
আজ অক্সফোর্ডে একটি রবিবার রাতে বসে অতীত নিয়ে এই লিখাটি লিখার আমার একটি উদ্দেশ্য আছে। আর তা হল ছোটদের জানানো যে, স্বপ্ন জয়ের পথে প্রতিকূলতা এবং বিফলতা আসবেই। স্বপ্ন যত বড়, সামায়িকভাবে হেরে যাবার বেদনাও তত বড়। বিফলতার আঘাত আমাদের সবারই নিতে কষ্ট হয়। এটা খুবই স্বাভাবিক। তুমি একা নও। হেরে যাওয়া এই ছোট ছোট যুদ্ধগুলো তোমার স্বপ্নের পথের সবচেয়ে বড় এবং অপরিহার্য যুদ্ধটি জয় করার জন্য তোমাকে তৈরি করবে। বিফলতার ভয়ে কোন চেষ্টাই যদি না কর, তাহলে তোমার কোন বিকাশই হবে না। ৩৯ বার বিফল হবার পর যদি আমি ৪০তম বার চেষ্টা না করতাম, তাহলে আজ এই গল্পটিও তোমাদের বলা হত না। তোমার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে হলে পরিশ্রম করতে হবে, বিফলতার স্বাদ নিতে হবে, পড়ে যাবার বেদনা পেতে হবে। মানুষ শুধু তোমার সফলতার কথা মনে রাখলেও তুমি কখনও হেরে যাবার সময়গুলো ভুলবে না। কারণ, সেই অভিজ্ঞতাগুলো ছাড়া সেই সফলতা অর্জন করা কখনও সম্ভব নয়। আজ আমার মাঝে যে আত্মবিশ্বাস দেখ, তা এক দিনে হয়নি। আমিও জানতাম না, আমিও ভয় পেতাম, আমিও সন্দিহান ছিলাম। কিন্তু হাল ছাড়িনি। তোমরাও ছাড়বে না। তোমাদের হতে হবে অনির্বাণ।
*ছবিতে আমি একটি এয়ারবাস A380 এর cockpit এ বসা।